মোঘল আমলের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লা

প্রকাশঃ মার্চ ১০, ২০১৫ সময়ঃ ১২:০২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:০৪ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:

lalbagh4সপ্তাহ ঘুরে আবার ছুটির দিন চলে আসলো। পুরো সপ্তাহের ধকলে নিশ্চয়ই হাঁসফাঁস অবস্থা সবার। তাই একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য শরীরের আরামের সাথে সাথে চাই মনেরও আরাম যাতে সামনের সপ্তাহটায় আবার পূর্নোদ্যমে কাজ করা যায়। আর এই মনের আরাম পেতে চাইলে পা বাড়াতে হবে ঘরের বাইরে। ছুটির দিনের বিকেলে বেড়িয়ে আসতে পারেন মোঘল আমলের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন ঢাকার লালবাগ কেল্লায়। কর্মব্যস্ত রাজধানীতে ছুটির দিনে ঘোরার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা আর হয়না।

ঘড়ির কাটায় বিকেল ৩ টা বেজে ৩০ মিনিট। যানজটহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রিক্সা চলছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে পারিপার্শিক দৃশ্য আর ভিন্ন ভিন্ন মানুষ দেখছিলাম। রোদ মুক্ত ঠাণ্ডা পরিবেশ। মানুষের হইচই আর রিক্সার ক্রিং ক্রিং হর্নের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। লালবাগ এলাকায় কেল্লার কাছাকাছি এসে ছোট রাস্তায় একটু জ্যামে আটকা পরি। পথচারী আর ছোট বড় গাড়ি মিলিয়ে লম্বা জ্যাম। দলে দলে মানুষ নানান সাজে সেজে কেল্লার পথে হেটে যাচ্ছে। সবার মুখে আনন্দের হাসি। চোখে দেখার আগ্রহ।

দেখে বোঝা যাচ্ছিল এ মানুষগুলো লালবাগ কেল্লার দর্শনার্থী। জ্যাম ঠেলে রিক্সা লালবাগ কেল্লার সামনের রাস্তায় পৌঁছালো। সীমানার দেয়াল ঘেষে ছোট রাস্তা। বুঝতে পারলাম একটু সামনেই লালবাগ কেল্লা। বা পাশে অনেক উচু কেল্লার সীমানার দেয়াল। দেয়ালের উচ্চতা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আরো একটু লোহার শিক মিলিয়ে উচ্চতা। দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। কেল্লার মোট তিনটি গেইট। সামনের দিকে দুইটি পিছনে একটি।

Lalbag-kellaলোহার বিশাল বড় এবং মজবুত রাজকীয় গেইট ঘাড় উচু করে দেখতে হবে। দুইটি গেইট সব সময় বন্ধ করে রাখা হয়। একটি গেইট ব্যবহার হয় সকলের প্রবেশ এবং বাহির হওয়ার জন্য। এরই মধ্যে রিক্সা মূল গেইটের সামনে। টিকিট কাউন্টারের সামনে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভীড়। মানুষের পেছন থেকে এক পা দু পা এগিয়ে টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট কিনে ভেতরে প্রবেশ করি।

ভেতরে প্রবেশ করেই সামনের দিকে বিবি পরীর সমাধি সৌধ দেখতে পেলাম। সামনের দিকে না এগিয়ে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম দর্শনার্থীদের চলাচল করার পথ, ভেতরের খোলা মাঠ সব কিছু খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য পথের দু`পাশে আকর্ষণীয় ফুলের গাছ। মাঠের ঘাসগুলো সবুজ সতেজ। ঘাসেও বিভিন্ন ডিজাইন করে ফুলের গাছ। শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধ সব বয়সের দর্শনার্থী মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ।

পেছন দিকটায় ছোট একটি লোহার গেইটের সামনে দর্শনার্থীদের ভীড় দেখতে পেয়ে এগিয়ে যাই সেখানে। এটি কেল্লার সুরঙ্গ পথ। এই পথ দিয়ে নাকি বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে যাওয়ার গোপন রাস্তা। তবে এখন আর এই পথ ব্যবহার করার সাহস কেউ করে না। এখান দিয়ে গেলে নাকি আর ফিরে আসা যায় না। কেউ যেন যাওয়ার চেষ্টা না করে তাই গেইটে বড় আকারের তালা ঝোলানো। গেইটের এপাশে দাঁড়িয়ে সুরঙ্গের ভেতরের দিকে উঁকি দিলে অন্ধকারে নিচের দিক নামানো ক`টি সিড়ি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। এটা দেখতেই মানুষের এতো কৌতুহল! এখানে দাঁড়িয়েই মূলত সবাই এই সুরঙ্গের ইতিহাস বলাবলি করে। ছোট শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কাছে জানতে চায় এর ইতিহাস।

63209375এখান থেকে পশ্চিম পাশের মসজিদটি এক নজর দেখে এলাম। কেল্লার পেছনে দক্ষিণ দিকে তিনটি গেইটের আরেকটি গেইট। এটিও এখন আর ব্যবহার হয় না। এই গেইটটিই আমার চোখে সব চেয়ে সুন্দর মনে হয়েছে। সেই আমলের নির্মাণ দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। পূর্ব পাশে গিয়ে একটি পুকুর দেখতে পাই। এটিতে একটু পানিও নেই। ওপর থেকে নিচের গভীরতা দেখা যায়। ঘড়ির কাটায় বিকাল ৫টা। চারিদিক থেকে বাশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। দর্শনার্থীদের থাকার সময় শেষ। লালবাগ কেল্লার নিরাপত্তাকর্মীরা বাঁশি ফু দিয়ে দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। সাথে হাত দিয়ে ইশারা করে সবাইকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। খুব অল্প সময় তাই এখানে আর আড্ডায় বসা গেলনা। তবে আমরা ঠিক করলাম আরেকদিন লালবাগ কেল্লায় আড্ডা করব। সেদিন সকাল সকাল চলে আসব। সবার সাথে আমরাও একে একে বের হয়ে যাই।

জেনে নিন লালবাগ কেল্লার ইতিহাস

লালবাগের কেল্লা বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রাচীন দুর্গ। মোঘল আমলে স্থাপিত এই দুর্গটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি পুরনো ঢাকার লালবাগে অবস্থিত, আর সে কারণেই এর নাম হয়েছে লালবাগের কেল্লা। এটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। বর্তমানে (প্রেক্ষিত ২০১২) বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ এই কেল্লা এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে।

প্রথমে এই কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। আর এই কেল্লার নকশা করেন শাহ আজম। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর ৩য় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মাত্র এক বছর পরেই দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে ঢাকায় এসে পুনরায় দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর এ দুর্গ অপয়া মনে করা হয় এবং শায়েস্তা খান ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ বন্ধ করে দেন।

এই পরী বিবির সাথে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরী বিবিকে দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে রাজকাজ পরিচালনা করতেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যাবার সময় দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের দান করে যান। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নানা কারণে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন কাজ শুরু করে।

এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

কি দেখতে পাবেন

কেল্লার অভ্যন্তরে রয়েছে একটি হাম্মামখানা বা গোসলখানা, দরবার হল, মাটির প্লাটফরম, ঝর্ণা, জলাধারা, তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদের ছাদে তিনটি গম্বুজের গোড়ার অংশ অষ্টকোণাকৃতি ড্রামের আকারের এবং পাতার নকশায় অলংকৃত। এতে রয়েছে পাড় বাঁধানো একটি পুকুর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নির্মিত জাদুঘর।

কেল্লার উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত প্রধান ফটক, উত্তর তোরণ, পশ্চিম তোরণ ও তিনতলাবিশিষ্ট আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে দক্ষিণ তোরণ। তোরণের সম্মুখে দু’পাশে তিনধাপে উপরে উঠেছে। প্রথম ধাপ একটি অর্ধগম্বুজ ছাদবিশিষ্ট আস্তরে তৈরি প্যানেল দ্বারা অলংকৃত। দরবার হলকে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়। জাদুঘরে রয়েছে মোগল আমলের অস্ত্রশস্ত্র, পান্ডুলিপি, মুদ্রা, মৃৎশিল্প, কার্পেট, চিত্র, হস্তলিপি ও রাজকীয় ফরমান।

প্রতিক্ষণ/এডি/সুমন

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G